বুধবার, এপ্রিল ৯, ২০২৫

রদ্রি কি যোগ্য ব্যালন ডি’ওর জয়ী?

সন্নিবেশ নাথঃ

ব্যালন ডি’ওর, ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ খেতাব। অলিতে-গলিতে, পাড়া-মহল্লায় বলে লাথি দিয়ে ফুটবলার হতে চাওয়া প্রতিটি শিশুর‌ই স্বপ্ন থাকে, একদিন ব্যালন ডি’ওর জয় করবে, পরবে শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট। 

১৯৫৬ সাল থেকে ফ্রান্স ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া এই ব্যালন ডি’র ২০২৪ এসে এর ৬৮তম আসরে পা দিয়েছে। গতকাল মধ্যরাতে স্প্যানিশ ফুটবলার রদ্রি, ব্যালন ডি’ওর জয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়ের খেতাব অর্জন করেন। ম্যানচেস্টার সিটির এই মিডফিল্ডার অসাধারণ এক মৌসুম পার করলেও তার ব্যালন ডি’ওর জয় নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নানান বিতর্ক।

কিন্তু কেন এই ব্যালন ডি’ওর ঘিরে এত বিতর্ক? আসুন জেনে নেওয়া যাক….

গত মৌসুমে, ক্লাবের ফুটবলের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা এবং লা লিগা জয় করে রিয়াল মাদ্রিদ। অরো ছিল, স্প্যানিশ সুপার কাপ এবং ইউএফা সুপার কাপ। এতসব ট্রফি জয়ে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ব্রাজিলিয়ান লেফট উইঙ্গার ভিনিসিয়াস জুনিয়র। বিশেষ করে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নকআউট পর্বে তার অতি মানবীয় পারফরম্যান্স তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে। গত মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের, রাউন্ড অফ ১৬ এর দুই ম্যাচে তার ১ গোল, কোয়ার্টার ফাইনালে ২ অ্যাসিস্ট, সেমিফাইনালের ১ম পর্বে ২ গোল এবং ফাইনালে ডর্টমুন্ডের বিরুদ্ধে জয় সূচক গোলটি করেন ভিনিসিয়াস। এছাড়াও লা লিগাতে ২৬ ম্যাচে ছিল তার ১৫ গোল এবং ৬ অ্যাসিস্ট। সব মিলিয়ে ৪৯ ম্যাচে ২৬ গোল এবং ১১ অ্যাসিস্ট। পরিসংখ্যানের দিক থেকে মেসি কিংবা রোনালদোর মত অতি মানবীয় মৌসুম পার না করলেও যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিল ভিনিসিয়াস।

জুনের ১ তারিখ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল জয়ের পর থেকেই বিভিন্ন শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকরা ভিনিসিয়াসের ব্যালন ডি’ওর জয়ের খবর প্রচার করতে থাকেন। এতটা নিশ্চিত ভাবে ভিনিসিয়াসের ব্যালন ডি’ওর জয়ের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল যে রিয়াল মাদ্রিদ‌ও রাজকীয়ভাবে ভিনির এই ব্যালন জয় উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়। ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় টানা ৫ ঘন্টা মাদ্রিদ টিভিতেও ব্যালন ডি’ওর অনুষ্ঠানটি সম্প্রচারের আয়োজন করা হয়। মাদ্রিদ থেকে প্যারিসের আগাম ফ্লাইটের টিকেট কেটে রাখা হয় ভিনিসিয়াস সহ আরো ৫০ জনের জন্য। বিখ্যাত স্পোর্টস প্রডাক্ট ব্র্যান্ড নাইকি ভিনিসিয়াসের জন্য ব্যালন জয় উপলক্ষে গোল্ডেন বুট বানায়। দুই মাস ধরে আরো হরেক রকমের আয়োজন চলে। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, ব্যালন ডি’ওরের তিন দিন আগে, বার্সেলোনার বিপক্ষে হওয়া এল ক্লাসিকো ম্যাচে চার গোলের ব্যবধানে হারার পরেও ভিনিসিয়াস বার্সা প্লেয়ার গাভিকে, “আমি সোমবার ব্যালন ডি’ওর জিততে চলেছি” বলে বড়াই করেছিলেন।

কিন্তু, হঠাৎ গতকাল ব্যালন ডি’ওর অনুষ্ঠানের আগে ফরাসি মিডিয়ায় গুঞ্জন ভাসতে থাকে– ভিনিসিয়াস নয়, এবারের ব্যালন ডি’ওর জিততে চলেছেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার রদ্রি। বিখ্যাত ফুটবল সাংবাদিক ফাব্রিজিও রোমানো‌ও যখন এই খবরটি নিশ্চিত করেন, তখন নেট দুনিয়ায় শোরগোল শুরু হয়ে পড়ে। সমর্থক থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, এর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করেন। খানিকক্ষণ পর, রিয়াল মাদ্রিদ‌ও ব্যালন ডি’ওরে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানে। তাদের দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি মাটি হয়ে যাওয়া যেন সমর্থকদের পাশাপাশি ক্লাব কর্তারাও মানতে পারছিলেন না। গোটা অনুষ্ঠানে রিয়াল মাদ্রিদের জেতা অন্যান্য পুরস্কারগুলোও গ্রহণ করতে রিয়াল মাদ্রিদের কেউ যায়নি। আর নেট জগতে সন্ধ্যা থেকেই  ভিনিসিয়াসকে সমর্থন করে নানান ফুটবলার সমবেদনা জানান। এসবের মাঝে সমর্থকদের চোখের বিষ হয়ে উঠে রদ্রি হার্নান্দেজ।

তাহলে কি আসলেই রদ্রি যোগ্য বিজয়ী ছিল না? 

রদ্রি একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। যার কাজ ডিফেন্স এবং মিডফিল্ডকে এক সুতোয় জোড়া। যদিও একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের গোল-অ্যাসিস্টের তেমন কোনো কাজ নেই, তারপরেও রদ্রি গোটা মৌসুমে ৯ গোল এবং ১৪ অ্যাসিস্ট করছেন। অতিমানবীয় পারফর্ম করে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের চ্যাম্পিয়ন করেছেন ম্যানচেস্টার সিটিকে। সিটিজেনদের তুলছেনে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিফাইনালে। এছাড়াও তার সবচেয়ে বড় অর্জন, স্পেনকে নিয়ে ইউরো জয়। ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে তার নজর কাড়া পারফরম্যান্স ছিল।

ভিনিসিয়াসের সাথে তুলনা করলে দেখা যাবে, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হয়ে‌ও রদ্রির (১৪) অ্যাসিস্ট সংখ্যা ভিনি (১১) থেকে বেশি। এমনকি ‘কি পাস’ অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ পাস, যার মাধ্যমে গোল হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি থাকে, ঐ তালিকাতেও রদ্রি ১০০টি ‘কি পাস’ নিয়ে ভিনিসিয়াস (মাত্র ৭০টি) থেকে এগিয়ে আছে। সফলভাবে রদ্রি যেখানে ৭২% ড্রিবলিং সম্পন্ন করেছেন সেখানে ভিনির ছিল মাত্র ৪১%। এছাড়া ৯৩% সঠিক পাস নিয়ে ভিনিয়াস থেকে যোজনে যোজনে এগিয়ে ছিলেন রদ্রি।

সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল, ব্যালন ডি’ওর জয়ে আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের ভূমিকা। যেখানে ইউরোতে দারুন একটি টুর্নামেন্ট কাটিয়ে স্পেনকে ইউরো জিতিয়েছেন রদ্রি, সেখানে ব্রাজিলের হয়ে কোপা আমেরিকাতে ভিনিসিয়াসের পারফরম্যান্স ছিল লজ্জাকর। মূলত এই কারণেই ব্যালন ডি’ওর ভোটিংয়ে পিছিয়ে যান ব্রাজিলিয়ান এই তারকা।

কিভাবে হয় ব্যালন ডি’ওরের ভোটিং?

ব্যালন ডি’ওর জয়ী নির্ধারিত হয় ভোটিংয়ের মাধ্যমে। যেখানে ফিফা ফুটবল রেংকের শীর্ষ ১০০টি দেশের ১০০জন ক্রীড়া সাংবাদিক, খেলোয়াড়ের তিনটি বিষয়ের উপর উপর ভিত্তি করে ব্যালন ডি’ওরের সম্ভাব্য জয়ীকে ভোট দিয়ে থাকেন। বিষয়গুলো নিম্নরূপ—

১. ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স

২. দলীয় অর্জন

৩. খেলোয়াড়ের আচরণ

অবশেষে, ভোটিংয়ের পর যার পয়েন্ট সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হয়, সেই খেলোয়াড় ব্যালন ডি’ওরের বিজয়ী হিসেবে জয়যুক্ত হয়ে থাকেন।

এসবের উপর ভিত্তি করে ব্যালন ডি’ওর ২০২৪ এর বিজয়ী রদ্রি হার্নান্দেজ। রদ্রির এই জয় স্পেনবাসীর জন্য ঐতিহাসিক। কারণ এর আগে কেবলমাত্র দুজন স্প্যানিশ এই মহামূল্যবান ট্রফিটি নিজের করে নিতে পেরেছিল, যার শেষবার ১৯৬০ সালে। অর্থাৎ, প্রায় ৬৪ বছর পর কোনো স্প্যানিশ জিতেছে ফুটবলের সর্বোচ্চ খেতাব। জাভি, ইনিয়েস্তা, বুসকেটসদের মতো কিংবদন্তিরা যা করে দেখাতে পারেননি, তা আজ করে দেখিয়েছেন রদ্রি।

সবশেষে, রিয়াল মাদ্রিদের ব্যালন ডি’ওরে অংশগ্রহণ না করা নিয়ে স্বয়ং লা লিগার সভাপতি জাভিয়ের তেবাস বলেছেন, “রিয়াল মাদ্রিদের উচিত ছিল ব্যালন ডি’অর অনুষ্ঠানে যাওয়া। আর ফ্রান্স ফুটবলকে প্রশ্ন‌ করা‌ও তাদের উচিত হয়নি।”

ব্যালন ডি’ওরের সম্পূর্ণ পুরষ্কার তালিকা…

সেরা তরুন খেলোয়াড়: লামিন ইয়ামাল (স্পেন, বার্সেলোনা)

সেরা গোলরক্ষক: এমিলিয়ানো মার্টিনেজ (আর্জেন্টিনা, এস্টন ভিলা)

সেরা নারী গোলদাতা: জেনি হারমোসো (স্পেন, বার্সেলোনা)

সেরা পুরুষ গোলদাতা: কিলিয়ান এমবাপ্পে (ফ্রান্স, রিয়াল মাদ্রিদ) এবং হ্যারি কেইন (ইংল্যান্ড, বায়ার্ন মিউনিখ)

সেরা নারী কোচ: এমা হায়েস (ইংল্যান্ড, আমেরিকা নারী ন্যাশনাল টিম)

সেরা পুরুষ কোচ: কার্লো আনচেলত্তি (ইতালি, রিয়াল মাদ্রিদ)

সেরা নারী খেলোয়াড়: আয়তানা বোনমাতি (স্পেন, বার্সেলোনা)

সেরা পুরুষ খেলোয়াড়: রদ্রি হার্নান্দেজ (স্পেন, ম্যানচেস্টার সিটি)

সেরা নারী ক্লাব: বার্সেলোনা

সেরা পুরুষ ক্লাব: রিয়াল মাদ্রিদ

সর্বাধিক পঠিত